হঠাৎ কারো খিঁচুনি হলে কী করবেন?
খিঁচুনি একটি স্নায়বিক রোগ। এ জন্য মস্তিষ্কের অতিসংবেদনশীলতা দায়ী। শিশু থেকে প্রাপ্তবয়স্ক, যেকোনো বয়সেই এটি হতে পারে। এসময় চেতনা হারাতে পারে, শরীর অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে পারে/ঝাঁকি দিতে পারে এবং ঠোঁট ঘনঘন বন্ধ হওয়া ও খুলতে পারে।
এছাড়া অন্য উপসর্গও প্রকাশ পেতে পারে। উপসর্গ প্রধানত নির্ভর করে মস্তিষ্কের কোন অংশ প্রভাবিত হয় তার ওপর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজনের জীবনকালে অন্তত একবার খিঁচুনি হতে পারে। সাধারণত খিঁচুনির স্থায়িত্ব ৩০ সেকেন্ড থেকে দুই মিনিট। তবে পাঁচ মিনিটেও খিঁচুনি বন্ধ না হলে মেডিক্যালের সেবা লাগবে, অন্যথায় মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মৃত্যু হতে পারে।
সকল খিঁচুনিই একই ধরনের নয়। খিঁচুনির প্রকারভেদে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট অংশ বা সকল অংশ প্রভাবিত হতে পারে। ফলত স্থায়িত্ব ও উপসর্গও ভিন্ন হতে পারে। এখানে ৬ ধরনের খিঁচুনি সম্পর্কে বলা হলো। কারো সমস্যাটি হলে কী করণীয় তাও উল্লেখ করা হলো।
* ফোকাল খিঁচুনি-
যুক্তরাষ্ট্রের এডভেন্ট হেলথে কর্মরত খিঁচুনি ও ঘুম বিশেষজ্ঞ হলি স্কিনার বলেন, ‘খিঁচুনিতে মস্তিষ্কের কেবল একটি অংশ প্রভাবিত হলে তাকে ফোকাল খিঁচুনি বলে।’ ফোকাল সিজারের দুটি সাবটাইপ রয়েছে- ফোকাল ইম্পেয়ারড অ্যাওয়ারনেস খিঁচুনি ও ফোকাল অ্যাওয়ার খিঁচুনি। প্রথম সাবটাইপের ক্ষেত্রে চারপাশ সম্পর্কে চেতনা হারিয়ে যায়। অন্যদিকে ফোকাল অ্যাওয়ার খিঁচুনির ক্ষেত্রে চারপাশ সম্পর্কে চেতনা থাকে এবং রোগী পরবর্তীতে খিঁচুনির সময় কি ঘটেছে তা মনে করতে পারে।
* ফিব্রাইল খিঁচুনি-
৩ মাস থেকে ৬ বছর বয়সী শিশুদের জ্বর ফিব্রাইল খিঁচুনি ঘটিয়ে থাকে। বয়স ৫ হওয়ার পূর্বেই ২ থেকে ৫ শতাংশ শিশুর এই খিঁচুনি হয়ে থাকে। এই খিঁচুনিতে মস্তিষ্কের সকল অংশ প্রভাবিত হয়। উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- উভয় হাত ও পায়ে অনিয়ন্ত্রিত কাঁপুনি, হাত ও পা অনমনীয় হয়ে যাওয়া, চোখ ওপরের দিকে ওঠে যাওয়া এবং জ্ঞান হারিয়ে ফেলা। সাধারণত ১৫ মিনিটের কম সময়ে এসব উপসর্গ সৃষ্টি হয়।শিশুদের খিঁচুনির স্থায়িত্ব ৩০ মিনিটের বেশি হলে মৃগীরোগের ঝুঁকি ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়ে। খিঁচুনির স্থায়িত্ব পাঁচ মিনিটের বেশি হলে তাকে স্ট্যাটাস এপিলেপ্টিকাস বলে। দীর্ঘস্থায়ী খিঁচুনি বা স্ট্যাটাস এপিলেপ্টিকাস পুনরাবৃত্তিমূলক খিঁচুনির ঝুঁকিও বাড়ায়।
* টনিক খিঁচুনি ও অ্যাটনিক খিঁচুনি-
টনিক খিঁচুনি ও অ্যাটনিক খিঁচুনিও মস্তিষ্কের সমস্ত অংশকে প্রভাবিত করে। উভয় খিঁচুনি মাংসপেশিতে প্রভাব ফেলে, তবে ভিন্নভাবে।কোনো প্রান্তীয় অঙ্গ অথবা পুরো শরীর তৎক্ষণাৎ অনমনীয় হয়ে গেলে তাকে টনিক খিঁচুনি বলে। অন্যদিকে অ্যাটনিক খিঁচুনির ক্ষেত্রে শরীরের নির্দিষ্ট অংশ বা পুরো শরীরের মাংসপেশি হঠাৎ করে শিথিল হয়ে পড়ে, জানান দ্য ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি ওয়েক্সনার মেডিক্যাল সেন্টারের স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ সারিটা মাচুরু। উভয় ধরনের খিঁচুনিতে রোগী জ্ঞান/চেতনা হারাতে পারে এবং পড়ে গিয়ে আহত হতে পারে। এসবের স্থায়িত্ব সাধারণত ১৫ থেকে ২০ সেকেন্ড বা আরো কম।
* ক্লোনিক খিঁচুনি-
ক্লোনিক খিঁচুনির স্থায়িত্ব কিছু সেকেন্ড থেকে এক মিনিট। এই খিঁচুনিতে ঘাড়, মুখমণ্ডল, হাত-পা অথবা পুরো শরীরে পুনরাবৃত্তিমূলক ও ছন্দময় ঝাঁকুনি হয়। মস্তিষ্ক কতটুকু প্রভাবিত হয়েছে তার ভিত্তিতে শরীরের একপাশে অথবা উভয় পাশে ঝাঁকুনি হয়ে থাকে। সমস্ত মস্তিষ্ক প্রভাবিত হলে রোগী চেতনা হারাতে পারে। এই রকম খিঁচুনি শিশুদের বেশি হয়ে থাকে, তবে যেকোনো বয়সের লোকেরও হতে পারে।
* টনিক-ক্লোনিক খিঁচুনি -
এই খিঁচুনিকে গ্র্যান্ড ম্যাল খিঁচুনিও বলা হয়। এই খিঁচুনিতে টনিক খিঁচুনি ও ক্লোনিক খিঁচুনি উভয় খিঁচুনির উপসর্গ অন্তর্ভুক্ত। প্রথমে পেশী অনমনীয় হয়ে যায় এবং হঠাৎ করে সচেতনতা কমে যায় বা চেতনা হারায়, টনিক খিঁচুনির মতো। তারপর প্রান্তীয় অঙ্গগুলো দ্রুত ছন্দোবদ্ধভাবে ঝাঁকুনি দিতে থাকে, ক্লোনিক খিঁচুনির অনুরূপ। ডা. স্কিনারের মতে, ‘টনিক-ক্লোনিক খিঁচুনির কিছু কারণ হলো- জিনগত প্রভাব, স্ট্রোক, মস্তিষ্কে আঘাত, টিউমার, মস্তিষ্কে সংক্রমণ ও অন্যকোনো প্রদাহজনিত সমস্যা। এই খিঁচুনি বিরল এবং যেকোনো বয়সে হতে পারে, তবে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বেশি লক্ষ্য করা গেছে।’
* অ্যাবসেন্স খিঁচুনি-
এ ধরনের খিঁচুনি হলে অল্প সময়ের জন্য সচেতনতা লোপ পায়। সাধারণত পাঁচ থেকে দশ সেকেন্ড। মস্তিষ্কের উভয় পাশে অল্প সময়ের অস্বাভাবিক কার্যাবলির জন্য এই খিঁচুনি হয়ে থাকে। অ্যাবসেন্স খিঁচুনির উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো- শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা, চোখের পাতা নাচা, চোখ ওপরের দিকে ওঠা অথবা ঠোঁট বন্ধ হওয়া ও খুলতে থাকা। এই খিঁচুনি বেশি লক্ষ্য করা গেছে চার থেকে ১৪ বছরের শিশুদের মধ্যে।তাদের ৭০ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছর হলে এই সমস্যা আর হয় না। অবশিষ্ট ৩০ শতাংশের জন্য দীর্ঘমেয়াদে খিঁচুনির ওষুধ লাগতে পারে।
*কারো খিঁচুনি হলে যা করবেন -
* মাথার নিচে নরম কিছু দিন, যেমন- বালিশ বা ভাঁজ করা জ্যাকেট।
* শ্বাসপ্রশ্বাস সহজ করার জন্য একপাশে কাত করে দিন।
* ক্ষতি করতে পারে এমন বস্তু সরিয়ে ফেলুন, যেমন- শক্ত বা সূচালো কিছু।
* ঘাড় বা গলায় কিছু (যেমন- টাই) থাকলে শিথিল করে দিন, যেন শ্বাসপ্রশ্বাস সহজে হয়।
* খিঁচুনির উপসর্গ ও সময় খেয়াল করুন, যেন ওই ব্যক্তিকে বিস্তারিত জানানো যায়।
*কারো খিঁচুনি হলে যা করবেন না
* শারীরিক নড়াচড়া বা ঝাঁকুনি থামানোর চেষ্টা করবেন না।
* মেডিক্যালের সাহায্য না আসা পর্যন্ত ছেড়ে যাবেন না।
* মুখের ভেতর কিছু দেবেন না, এতে শ্বাসরোধে মারা যেতে পারে অথবা অন্যকোনো ক্ষতি হতে পারে।
* মুখে মুখ লাগিয়ে বাতাস দেবেন না।
* পূর্ণ সচেতনতা বা চেতনা না আসা পর্যন্ত কোনো খাবার বা পানীয় খেতে দেবেন না।
(আপনারা দয়া করে এখানে থাকা বিভিন্ন বিজ্ঞাপনের উপর ক্লিক করে জিনিস কিনুন, তাহলে আমি কিছু কমিশন পাব।)